পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের সাবেক প্রধান আশফাক মাহমুদের সামনে বসে আছে ২২ বছর বয়সী দুর্ধর্ষ
আসামী ফয়সাল । আজ ২১শে ডিসেম্বর বিকেল ৪ টা । আশফাক মাহমুদ অল্প অল্প ঘামছেন ।
যদিও ২৫ বছরের চাকরী জীবনে গোটা বিশেক ইনকাউন্টার , এবং নাম মনে না
পড়া কত শত অভিযানের অভিজ্ঞতা । সে সবের সাহসীকতার মাপ কাঠি এই ২২ বছরের যুবকের
সামনে ম্লান হয়ে পড়ছে । অযথা ব্লাড প্রেশারের অযুহাতে ঘাম মুছতে মুছতে যুবকের
চোখের তাচ্ছিল্যের জবাব দিচ্ছেন তিনি । কিন্তু ফয়সাল ম্লান মুখে হাত দুটো ভাজ করে
মাটির দিকে মাথা নিচু করে চুপ চাপ
বসে আছে । যতখন না
২০০ ওয়াটের বাল্ব টা ঝট
করে জ্বলছে ততখন কারও মুখে কথা নেই ।
বাল্ব জ্বলার পরে আশফাক সাহেব মৃদ কেশে গলা
পরিষ্কার করে যেই কিছু বলতে যাবেন সেই তার গলা বসে পড়ছে । যে যুবক এখন পর্যন্ত
গোটা বিশেক পুলিশ মার্ডার করেছে ৪ জন স্থানীয় তেজী নেতাকে হত্যা করেছে সেই যুবক
কিনা ভাবলেশ হীন ভাবে একমনে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে যা অবিশ্বাস্য । যুবকের
চেহারায় পৃথিবীর কোনো ধরণের কোনো অনুভূতি ফুটে উঠছেনা । আসামীর চেহারার ভাষা পড়ার
যে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা সব বৃথা যাচ্ছে ।
তারপরেও গুমোট ২০০ ওয়াটের আলোর ভ্যাপসা গরম ঘরে
মৃদ কেশে আশফাক সাহেব প্রশ্ন করা শুরু করলেন ।
আশফাক সাহেবঃ তোমার নাম কী ?
যুবকঃ ফয়সাল ।
আশফাক সাহেবঃ প্রথমেই তোমার
মুখ থেকেই শুনি কিছু । তোমার জীবনের এমন কিছু গল্প বলো যা এখন তোমার মনে ভাসছে
।
যুবকঃ আমার নাম
ফয়াসাল , ফয়সাল আহমেদ । আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি যখন আমার বাবা মারা যায় । আমাকে লাশ টাও দেখতে দেয়া হয়নি । বাবার প্রতি
দেখা মাত্রই গুলি করার অর্ডার দেয়া হয়েছিল , যদিও সে সময়
তিনি নিরস্ত্র ছিলেন ।বাবা মাত্র তার প্রিয় চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন মাত্র ।তখন রাশ
মেলা চলছিল । ভারত থেকে এবং এ দেশ থেকে লাখো মানুষ জড় হচ্ছিল বাবাও তাদের সাথে
লঞ্চে , ট্রাকে-বাসে করে সেদিকেই যাচ্ছিলেন । বাবার
প্ল্যান ছিল কোনো রকমে ভারত পালিয়ে যাওয়া শত ভিড়ের মাঝে । বাবা আমাকে আর মাকে
আলাদা আলাদা করে চিঠি লিখেছিলেন , বাবা আমাকে বলেছেন উনি আর মন্দ কাজ
করবেন না । ভাল হয়ে যাবেন । যখন পুলিশ ওনাকে খোঁজা বন্ধ করে দেবে তখন তিনি ফিরে
আসবেন । কিন্তু তা আর হয়নি । প্রত্যন্ত এক গ্রামে বাবাকে হত্যা করা হয় ।
আশফাক সাহেবঃ আমি যতটুকু
জানি তোমার বাবাকে সুন্দরবনের ডাকাত রা হত্যা করে । তাও ইচ্ছে করে নয় , গোলাগুলির
মাঝে তোমার বাবার গায়ে গুলি লেগে যায় ।
যুবকঃ কিন্তু যারা
বাবাকে গুলি করেছিলো তারা পুলিশের তালিকা ভুক্ত দুর্ধর্ষ আসামী ছিল । তারা কি করে
একটা গ্রামে প্রতাপের সাথে ঘুরে বেড়ায় ! বাবা তো ভাল হয়ে যেতে চেয়েছিলেন । আচ্ছা
আপনি ঘামছেন কেন !
আশফাক সাহেবঃ ঘাম মুছতে
মুছতে ! ২০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বললে ঘাম তো পাবেই ।
যুবকঃ তবে বাল্ব বন্ধ করুন ।
আশফাক সাহেবঃ না এটা নিয়ম , জিজ্ঞাসাবাদে
এটা অপরিহার্য ।
যুবকঃ হ্যাঁ । আপনাদের সিস্টেম (তাচ্ছিল্যের সুরে)
আশফাক সাহেবঃ ওসব বাদ দাও ।
আরও কিছু বলবে ? নাকি শেষ হয়েছে , আমার অনেক
প্রশ্ন করার আছে ।
যুবকঃ না আপাতত থাক ।
আপনি প্রশ্ন শুরু করুন ।
আশফাক সাহেবঃ এতোগুলো হত্যা
কান্ড ঘটানোর পর তুমি পালিয়ে না গিয়ে ধরা কেন দিয়েছো ?
যুবকঃ এ প্রশ্ন সব
শেষে করা হউক ।
আশফাক সাহেবঃ আচ্ছা ঠিক আছে
। প্রথম খুন কাকে করেছিলে ?
যুবকঃ সবুজ গঞ্জের
সাবেক ওসি । দিদারুল মিয়া কে ।
আশফাক সাহেবঃ কারণ ?
যুবকঃ ওই থানা এলাকায় ২০০৩ সালে ঐশী নামে একটি মেয়ে
পানিতে পড়ে মারা যায় । বাধ্য হয় সে পানিতে ঝাপ দিতে । ৪ বখাটে ধর্ষণে উদ্যত হয়েছিল। মেয়েটির কিছু করার ছিলনা ।ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া
মেয়ে ।ওসি সাহেব চেয়ারম্যানের ছেলে সহ বাকি ৩ যুবক কে আটক করেন নি । বিশাল অংকের
ঘুষ খেয়েছেন । সাথে ওনার অধিনস্থ সবাই । আমি ভেবেছিলাম ওসি সাহেব কে আপনাদের
সিস্টেম ই সাজা দেবে কিন্তু তা আপনারা নিশ্চিত করেন নি , অতএব আইন টা আমার নিজের
হাতেই তুলে নেয়া দরকার ছিল ।
আশফাক সাহেবঃ এসবের জন্য তোমাকে কেন ভাবতে হবে ? তোমার এতো দায় কেন ?
যুবকঃ যে সিস্টেমের
জন্য আমার বাবাকে খুন হতে হয়েছে সে সিস্টেমকে কেন সব স্থানে প্রয়োগ করা হবেনা ! আর
যদি প্রয়োগ না হয় তবে আমিই প্রয়োগ করেছি । এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি তাই ধরা দিয়েছি
আপনার কাছে ।
আশফাক সাহেবঃ কিন্তু তুমি এতোগুলো মার্ডার কিভাবে করলে ? ধরা কেন পড়োনি ?
কিভাবে ওসি সাহেব কে খুন করেছিলে ?
যুবকঃ সে অনেক বড় লম্বা
কাহিনী । প্রায় দু বছরের প্ল্যান । এবং সাথে আছে একাগ্রতা আর টাকা ।
আশফাক সাহেবঃ টাকা কোথায় পেলে ।
যুবকঃ ব্যাংক ডাকাতি ।
ঢাকা আরাফাত ব্যাংক ।
আশফাক সাহেবঃ বিস্ফোরিত চোখে ! কি ! ওটা তুমি ছিলে ? আড়াই বছর ধরে শুধু
সে ব্যাংক চোর কে ধরার জন্য পুলিশের ২২ জন স্পেশাল সদস্য কাজ করে চলছে আর এখানে
.........
যুবকঃ অতটা বিস্ময়
প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করছিনা । ব্যাপার টা অনেক সিম্পল ছিল । সস্তা বিল্ডিং এ ব্যাংকের শাখা ভবন ভাড়া নেয়া হয় । ভল্ট
রুমের দেয়াল মাত্র এক পরদ ইটের চাদরে ঢাকা ছিল । রাত তিনটায় ভল্ট রুমের পেছনের
দেয়ালে ৫ টা ডেটনেটর স্থাপন করেছি । দেয়ালের হাজারো টুকরো যখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে
তখন পাশের মসজিদে আজান শুরু হয় । আরও ৫ টা মাইক বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেছি ।
আজানের উচ্চ শব্দে এলাকা বাসি কিছু টের পায়নি । কাছের যারা টের পেয়েছিল তারা পাত্তা
দেয়নি । বর্ষা কাল ভেবেছিল বাজ পড়েছে । উত্তরা থেকে সিটি কর্পোরেশনের ক্রেণ ট্রাক
আগেই চুরি করেছিলাম সন্ধ্যায় , পরের তিন দিনেও কর্পোরেশনের লোক টের পায়নি ওটা খোয়া
গিয়েছে । ঝালাই মেশিন দিয়ে ভল্ট ওখানেই ঝালাই করে আটকে নেই ক্রেণের সাথে । তারপর
উত্তরার আপনাদের ময়লার বড় ভ্রাম্যমাণ ডাস্টবীনের ভেতর ভল্ট টা ফেলে আপনাদের সামনেই
নিয়ে ঢাকা থেকে বেরিয়ে যাই । তারপর এক ঘন্টা রিসার্চ করি কোন থানার ওসি সব চেয়ে
বেশি দুর্নীতি বাজ । খবর পাই সবুজ বাগ থানার সেই সাবেক ওসি । তখন উনি চিটাগং
পাচলাইশের ওসি । প্রথমেই ওনাকে কিনে নেই । বেচারা একটু তদন্ত অ করে দেখেনি আমি এতো
টাকা কোথায় পেলাম । চিটাগং এ দেহ ব্যবসার নাম করে ২০ লাখ টাকা ওনার ঠিকানায় লোক
মারফত টাকা পাঠাই আর আন্তর্জাতিক দেহ ব্যবসার নাম ভাঙিয়ে ক্রমাগত টাকা পাঠাতে থাকি
আর সম্পর্ক উন্নয়ন করি । তখন পর্যন্ত আমি আড়ালেই থাকি । কিন্তু মাঝ পথে যখন জানতে
পারি ওনার মুখ থেকেই ঐশীর ব্যাপার টা তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা । পকেটে থা
১৯-এম এম দিয়ে গুলি করে দেই রাঙামাটির নির্জন পাহাড়ে । যেহেতু উনি আমার ওপর অনেক
আস্থা নিয়ে ফেলেছিলেন । আনি ওনাকে বলেছিলাম আমাদের দেখা হওয়ার ব্যাপারটা উনি ছাড়া
যেন আর কেউ না জানে । তাই পুলিশ আমাকে খুঁজে বের করতেও পারেনি । ব্যাপারটা অত কঠিন
কিছু নয় ।
আশফাক সাহেবঃ তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি আগে থেকেই ওনাকে খুন করতে প্রস্তুত ছিলেনা ,
তাহলে কেন শুধু শুধু টাকা পাঠাচ্ছিলে অবৈধ দেহ ব্যাবসার নাম করে?
কেন সম্পর্ক উন্নয়ন
করছিলে ?
যুবকঃ প্রথমত আমার
ইচ্ছে ছিল শহরের রাঘব বোয়ালদের হাতে নেয়ার । আমি নিয়ে ফেলেছিও । কেউ আমাকে চিনেনা
এখনো কিন্তু আমার কন্ঠটার কাছেই এখনো সবাই জিম্মি । আমি প্রথমে প্ল্যান করেছিলাম
যেসব মেয়েরা ইচ্ছে না থাকা সত্বেও দেহ ব্যবসায় জড়িত তাদের পুনর্বাসন করতে । এবং
প্রায় হাজার খানেক নারী কে পুনর্বাসন করে ফেলি অলরেডি । সেই সাথে দেহ ব্যাবসা চালু
থাকে সেখান থেকে যে প্রফিট আসতো তাই দিয়ে ওদের পুনর্বাসন হতো । নতুন মেয়ে আনা
হতোনা । শহরে নতুন মেয়ে এসবে নামলে অথবা পাচার হয়ে বাধ্য হয়ে আসলে আমি তাদের কিনে
ফেলতাম আর পুনর্বাসন করতাম । কিন্তু যখন সবুজ গঞ্জের ওসির ব্যাপারে ডিটেইলস জানি
তখন রাগে গা রি রি করছিলো । নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি । ওসির মৃত্যর পর আমার
দেহ ব্যাবসার চেইন টা ভেঙ্গে পড়ে , নতুন ব্যবসায়ী রা আমার ক্লাব গুলো একেরত পর এক
পুলিশের মাধ্যমে বন্ধ করে দেয় । ওদিকে ভল্টের টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন ওসিকে ও
কিনতে পারিনি । মেয়েদের উদ্ধার করার মিশন আর পসিবল ছিলনা তাই একের পর এক দুর্নীতি
বাজ পুলিশ অফিসার দের হত্যা করা শুরু করি । আমি জানি আমি যা করেছি তা সব ভুল ।
কিন্তু এই সিস্টেমই আমাকে বাধ্য করে এসব করতে । এ সিস্টেমের কারণে বাবা মারা যায় ,
মা আত্মহত্যা করে । এখন আমার জীবনে কিছু নেই করার তাই এসবই আমার সম্বল । যার কিছু
নেই যার কোনো আশা নেই যে কিনা সু বিচার পায়না তাকে আমার সব টুকু উজাড় করে দিতে হয়
। আমি আমার জীবনে এসব করেই শান্তি পাই । খুন আমার রক্তে মিশে আছে । খুন করেই আমার
স্বস্তি ।
আশফাক সাহেবের মাথা ধরছে , ২০০ ওয়াটের বাল্ব নিভিয়ে
চুরুটের প্যাকেট থেকে এক শলাকা নিয়ে ঠোঁটে পুড়লেন , গুমোট অন্ধকার ঘরটাকে তামাকের
ধোয়ায় আচ্ছন্ন করে ফেললেন । যুবক শুধু ভাবলেশ হীন ভাবে হাত দুটো ভাজ করে মেঝেতে
তাকিয়ে আছেন । আশফাক সাহেব এখনো যুবকের চোখে কোনো অনুভূতির লেশ মাত্র দেখতে
পাচ্ছেন না ।
ভৌতিক থ্রিলার উপন্যাস https://chonnocharaa.blogspot.com/2019/02/blog-post_57.html?m=1
ReplyDelete